উপমহাদেশে জায়নবাদ ও হিন্দুত্ববাদের কোলাকুলি


নির্বাচন কমিশন বিএনপি ও বিরোধী দলের দাবিদাওয়ার প্রতি কোন কর্ণপাত না করে একতরফা নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। এটা কার্যত বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এবং এশিয়ায় মার্কিন ভূরাজনৈতিক স্বার্থের বিপরীতে আঞ্চলিক পরাশক্তি হিশাবে দিল্লির পেশী প্রদর্শন। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, এটা তারা বারবার বলেছে; জনগণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দিয়ে সরকার বদলাক, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হোক -- সেটাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের অনুকুল। চিন ও মায়ানমার মোকাবিলার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। কুটনৈতিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে এবং স্যাংকশান দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘকাল ধরেই বাংলাদেশে তারা সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, সেটাই বোঝাতে চেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকা কিম্বা মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধবিগ্রহকে আমরা কিভাবে বিচার করব বা করি সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় কেন মার্কিন যুক্ত্রাষত্র অস্থিতিশীল বাংলাদেশ চায় না। তার যুক্তি রয়েছে। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় পরাশক্তি হয়ে ওঠার যে খায়েশ দিল্লী প্রদর্শন করছে সেই ক্ষেত্রে স্থিতিশীল বাংলাদেশই যুক্তরাষ্ট্রের কাম্য। তদুপরি মায়ানমারের পরিস্থিতি মোকাবিলা, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সংকট এবং বাংলাদেশের ওপর দিল্লীর একচ্ছত্র আধিপত্য ওয়াশিংটনের মনঃপূত নয়। কিন্তু ওয়াশিংটন এমন কিছু করতে চায় না যাতে দিল্লির সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়ে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে শেষ কথা চিন মোকাবিলা, ফলে দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ করতে চাইবে না যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সেখানে টানাপড়েন তৈরি হয়েছে এবং হবে।

দিল্লীর খায়েশ পরিষ্কার। দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকসের সম্মেলনে বোঝা গিয়েছে দিল্লী নিজেকে দক্ষিণের দেশগুলোর নেতা ভাবে এবং দক্ষিণের একচ্ছত্র নেতা হবার বাসনা পোষণ করে। জি-২০ মিটিং-এর সময়ও সেটা দিল্লী বেশ জোরে সোরে প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় দিল্লিকে বাদ দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বাড়ুক এটা দিল্লী চায় না। সেটা পরিষ্কার ভাবে জানান দেবার সুযোগ এসে যায় ৭ অক্টোবর হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর। দিল্লী-ওয়াশিংটন ‘টু-প্লাস-টু’ সভার পর থেকে দিল্লীর আওয়াজ সশব্দ হতে শুরু করে। দিল্লি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিতে শুরু করে যে তারা একশ ভাগ বাংলাদেশে তাদের তাঁবেদার ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তির পেছনেই রয়েছে। বাংলাদেশে বিএনপির সঙ্গে কোন আলোচনা বা সমঝোতা ছাড়া যে তফসিল ঘোষণা করা হোল সেটা বাংলাদেশকে দিল্লির পরাধীন রাখবার নীতি। এর ফল শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশের জন্য ভাল হবে না।

বাংলাদেশের জনগণ বর্তমান ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ব্যবস্থা থেকে মুক্তি চায়। বিরোধী দল নির্বাচনবাদী নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করছে। নির্বাচনের দাবি ছাড়া তাদের কোন র‍্যাডিকাল দাবিদাওয়াও নাই। ফলে বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দিল্লির স্বার্থের বিরোধী হবার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। কিন্তু দিল্লী ফ্যাসিস্ট শক্তিকে একনিষ্ঠ ভাবে সমর্থন দিয়ে এক তরফা জয়লাভের যে সুযোগ করে দিতে চাইছে তার পরিণতি উপমহাদেশের জন্য ভাল হবে না। বিএনপির সঙ্গে কোন আলোচনা বা সমঝোতা ছাড়া একতরফা তফসিল ঘোষণা বাংলাদেশকে পুরাপুরি দিল্লীর দখলদারির অধীনে নেবার পদক্ষেপ। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এটা মেনে নেবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে কোন শর্ত ছাড়া শেষ বারের মতো আলাপ আলোচনার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু তাকেও উপেক্ষা করে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তি স্পষ্টতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশ প্রশ্নে দিল্লির সঙ্গে ওয়াশিংটনের শেষ সংলাপ ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়। রাজনীতিতে আমরা আরেকটি স্তরে প্রবেশ করলাম।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পালাবদল ঘটছে দ্রুত। প্যালেস্টাইন প্রশ্নে এবং হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর বাহ্যিক ভাবে জো বাইডেনের দৃঢ় সমর্থন থাকলেও মার্কিন প্রশাসন পুরাপুরি ইসরায়েলকে এবার সমর্থন করছে না, এমন লক্ষণ পরিষ্কার। জায়নিস্ট ইসরায়েলের নির্বিচারে বোমা বর্ষণ, গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধ – বিশেষত হাসপাতালে বোমা বর্ষণ ও শিশু হত্যার ফলে বিশ্বজনমত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তীব্র হয়েছে। এই নাজুক অবস্থার সুযোগ দিল্লি নিচ্ছে এবং নেবে। বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পুনর্বার সাজানো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত করবার পক্ষে তাই দিল্লি দাঁড়িয়েছে। ভারতের পত্রপত্রিকা এবং সরকারি ভাষ্যে সেটা ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে উঠছে। বিএনপির সঙ্গে জোটে থাকলেও অনেকগুলো দলই এখন নির্বাচনে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিম্বা নেবে। কল্যাণ পার্টি ও জাতীয় পার্টিকে আমরা দেখছি। অনুমান করা কঠিন নয় যে এইসব ছোটখাট দল দিল্লীর স্থানীয় এজেন্টের অধিক কিছু কখনই ছিল না। সামনে আমরা আরও অনেক দলকেই দেখব। এইসব পরিষ্কার হয়ে যাওয়া ভাল। কিন্তু বিএনপি এই চাপ কতোটুকু নিতে পারবে বোঝা মুশকিল। বিনেপির তরুণ নেতৃত্বকে হতাশ হলে চলবে না। দূরদর্শী হতে হবে। বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া কোন ভূয়া বা সাজানো নির্বাচন বৈধ হবে না। এর দ্বারা স্থিতিশীল বাংলাদেশ অসম্ভব। ঋণে বাংলাদেশ জর্জরিত এবং অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক। ফলে বিএনপির আসলে হারাবার কিছু নাই। জনগণ অন্তঃসারশূন্য নির্বাচন মেনে নেবে না। বরং দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিস্ট শক্তির এজেন্ট ও দিল্লীপন্থি দালালরা নির্বাচনে গেলে দল আরও শক্তিশালী হবে। এই ঝাপটা বিএনপি কিভাবে সামলাবে তার ওপর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে।

কিন্তু বিএনপির জন্য পরিস্থিতি মোটেও খারাপ হবে না। বিএনপির বরং চেষ্টা করতে হবে কিভাবে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও অভিপ্রায় সরল ও স্পষ্ট ভাষায় জনগণের কাছে হাজির করা যায়। এই ক্ষেত্রে বিএনপি প্রচণ্ড দুর্বল আর এটাই তার ক্ষতির প্রধান কারন হবে। নির্বাচন হলেও ভূয়া নির্বাচন করে মাফিয়া ও লুটেরা শক্তির ক্ষমতায় টিকে থাকা অসম্ভব। বরং এতে বিএনপি আরও শক্তিশালী হবে। অভিজ্ঞতা বিএনপিকে কতোটা গণমুখি করবে সেটা আমরা আগাম বলতে পারি না। তবে ঘোষিত তফসিলের ভিত্তিতে নির্বাচন হওয়ার অর্থ বাংলাদেশে নতুন গণমুখি রাজনীতির ধারা শক্তিশালী হওওয়ার শর্ত তৈরি হওয়া। ফ্যাসিস্ট শক্তিকে একমাত্র গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমেই উৎখাত করতে হয়। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।

ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার স্বার্থে বাংলাদেশের জনগণকে মনে রাখতে হবে ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও নিবিড়। ভারতের অস্ত্রশস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রির ক্ষেত্রে ভারত অন্য সব দেশের তুলনায় অগ্রগামী। প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে দিল্লী ও তেলআবিবের সম্পর্ক অনেক গভীর। বিশেষত আদর্শিক দিক থেকে জায়নিজম ও হিন্দুত্ববাদের মধ্যে পার্থক্য অতোটুকুই যে ভারত সেটলার কলোনিয়াল রাষ্ট্র নয়। কিন্তু জায়নিস্টদের মতো হিন্দুত্ববাদও মনে করে ভারত শুধু হিন্দুদের দেশ, অন্যেরা ‘বহিরাগত’। অর্থাৎ মুসলমান ভারতবর্ষে বহিরাগত। দিল্লী বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। বিশেষত যেখানে ইসরায়েল যেখানে ভারতের গোয়েন্দা সহযোগিতার অত্যন্ত বিশ্বস্ত অংশীদার।

প্যালেস্টাইন প্রশ্নে দিল্লির অবস্থানেরও পরিবর্তন ঘটেছে। নরেন্দ্র মোদির ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী সরকার অভ্যন্তরীণ প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের শায়েস্তা করতে যেসব নজরদারি সফটওয়্যার ব্যবহার করছে, সেগুলো ইসরায়েল সরবরাহ করে। মনে রাখা দরকার মোদিই ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি ইসরায়েল সফর করেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে তিনি বৈঠক করেছেন। উভয়ের হাস্যোজ্জ্বল দোস্তির ছবি হিন্দুত্ববাদী ভারতের সর্বনাশা রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের জন্য পরিষ্কার হুঁশিয়ারি। নেতানিয়াহু নিজেও ভারত দুইবার সফর করেছেন।

গত ৭ অক্টোবর হামাসের সামরিক অভিযানের পর নরেন্দ্র মোদি সঙ্গে সঙ্গে টুইট করে জানিয়েছিলেন, ‘ইসরায়েলের দুঃসময়ে তার পাশে আছি।’ সেটাই একমাত্র টুইট নয়। এরপর তিনি ইসরায়েলের প্রতি সংহতি জানিয়ে আরও একটি টুইট করেন। মোদির ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সমর্থকগণ গাজায় ইসরায়েলি বোমাবর্ষণ ও নির্বিচারের শিশু, নারী হত্যা দেখে যেভাবে উল্লাস প্রকাশ করেছে সেটা ছিল অশ্লীল ও নির্মম। ভারতের মুসলমানদের প্রতি তাদের ঘৃণ্য বিদ্বেষ গোপন কিছু নয়। ইসরায়েলের কঠোর প্রতিক্রিয়া হিন্দুত্ববাদিদের উৎফুল্ল করেছে।

কিন্তু গাজায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এবং আশপাশের এলাকা, হাসপাতাল ও উপাসনালয় ধ্বংসের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর মোদির ভারত তার একপেশে অবস্থান নিয়ে পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হয়। বিশেষত মধ্য প্রাচ্যের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক খারাপ হবার ভয় রয়েছে। ইসরায়েলের হামলার বেশ কয়েক দিন পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি জারি করেছে। তাতে ভারত ‘ইসরায়েলের সঙ্গে নিরাপদ ও স্বীকৃত সীমানার মধ্যে বসবাসকারী ফিলিস্তিনের একটি সার্বভৌম, স্বাধীন এবং কার্যকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সরাসরি আলোচনা পুনরায় শুরু করার’ আহ্বান জানিয়েছে। ভারতে মুসলমানদের প্রতিক্রিয়াও মোদিকে সতর্ক করেছে। দ্বিতীয়ত মোদির অবস্থান কাতারের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক শীতল কিরে দিতে পারে, সে সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে ভারতের দীর্ঘস্থায়ী নীতিগত অবস্থান দিল্লি পুনরায় ব্যক্ত করেছে বটে, তবে তার নগ্ন চেহারা ধরা খেয়ে গিয়েছে যখন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘অবিলম্বে মানবিক যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণা দেওয়ার জন্য ভোট দেওয়ার আহ্বান্র দিল্লির ভূমিকা ছিল নেতিবাচক। দিল্লি সেই প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে।

হিন্দুত্ববাদী ভারতের এই হোল আসল চেহারা। আমাদের বুঝতে হবে এটা নেহেরুর ভারত নয়। প্যালেস্টাইনের জনগণের প্রতি হিন্দুত্ববাদী ভারতের দৃষ্টিভঙ্গী ইসরায়েল দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আলাদা কিছু না। একই দৃষ্টিতে হিন্দুত্ববাদী দিল্লী বাংলাদেশকে দেখে। সেই আলোকে বাংলাদেশের বিপদ বাংলাদেশিদের বুঝতে হবে। বাংলাদেশ হিন্দুত্ববাদী দিল্লির চোখে দিল্লির ‘গাজা’ । সম্ভব হলে ১৭ কোটি লোককে তাড়ীয়ে হিন্দুত্ববাদিরা বাংলাদেশ ভূখণ্ড দখল করে নিতে দ্বিধা করবে না।

বিএনপি ও বিরোধীদলের সঙ্গে কোন সমঝোতা ছাড়া একতরফা নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা কার্যত সেই সংঘাতময় পরিস্থতি তৈরির উদ্যোগ। বাংলাদেশকে ইন্দো-ইসরায়েলি ভূ-রাজনীতির যূপকাষ্ঠে চড়ানো চলছে।

23 novebar 2023

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।